বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা শেরপুর। প্রকৃতির সবুজ ছোঁয়ায় ঘেরা হলেও পর্যটনের দিক থেকে এখনও অনেকটাই অনাবিষ্কৃত। রাজধানী থেকে যোগাযোগব্যবস্থা তেমন উন্নত নয় বলেই হয়তো এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন তুলনামূলকভাবে কম মানুষ। কিন্তু যাঁরা প্রকৃতির নীরবতা, পাহাড়ি টিলা আর অরণ্যের শান্ত সুরে মন ভেজাতে চান— তাঁদের জন্য শেরপুর হতে পারে এক অনন্য গন্তব্য। এখানে এমন পাঁচটি স্থান রয়েছে, যেগুলো এক থেকে দুই দিনের সফরে ঘুরে আসা যায় খুব সহজেই।
১. পানিহাটা–তারানী পাহাড়: মেঘ, পাহাড় আর নদীর মিলনভূমি
জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া অঞ্চলে অবস্থিত দুটি পার্বত্য গ্রাম— পানিহাটা ও তারানী পাহাড়। সারি সারি টিলা, ঘন সবুজ বন আর নিচে বয়ে চলা পাহাড়ি ভোগাই নদী— সব মিলিয়ে এক স্বপ্নময় পরিবেশ।
নদীর স্বচ্ছ পানিতে সূর্যের আলো পড়লে নিচের নুড়িপাথরগুলো ঝিকমিক করে ওঠে। দূরে ভারতের তুরা পাহাড়ের টিলাগুলো মেঘের সঙ্গে খেলা করে যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্মের মতো লাগে। গ্রামের পাশেই রয়েছে একটি খ্রিষ্টান উপাসনালয়, একটি ছোট বিদ্যালয় ও আবাসিক হোস্টেল— যা পুরো জায়গাটিকে করে তুলেছে শান্ত, নিরিবিলি এবং একদম ছবির মতো সুন্দর। কয়েক ঘণ্টা প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানোর জন্য জায়গাটি নিঃসন্দেহে আদর্শ।
২. বারোমারী খ্রিষ্টান মিশন: ইতিহাস ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন
১৯৪২ সালে গারো পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপিত বারোমারী খ্রিষ্টান মিশন একদিকে যেমন ধর্মীয় স্থাপনা, অন্যদিকে তেমনি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। প্রায় ৩৯ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা এই মিশন এলাকায় রয়েছে একটি প্রাচীন গির্জা, একটি স্কুল ও কৃষিজমি।
এখানকার নীরবতা, সুশৃঙ্খল গাছপালা ও দারুণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তবে গির্জা পরিদর্শনের আগে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া জরুরি। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এটি একবার অন্তত ঘুরে দেখার মতো জায়গা।
৩. গারো পাহাড় অবকাশ কেন্দ্র: ছায়া, শীতলতা ও শান্তির ঠিকানা
ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই অবকাশকেন্দ্রটি প্রকৃতি ও বিনোদনের অপূর্ব সমন্বয়। সারি সারি শাল, সেগুন ও গজারিগাছ, ঝরনার টলমলে ধারা, কৃত্রিম লেক, সেতু— সব মিলিয়ে এটি শেরপুরের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।
পাহাড়ের চূড়ায় আছে আধুনিক ছয় কক্ষবিশিষ্ট রেস্টহাউস, যেখান থেকে চারপাশের দৃশ্য মন ভরিয়ে দেবে। নিচে নেমে আসার জন্য আছে আঁকাবাঁকা ‘পদ্মা সিঁড়ি’। পর্যটকদের জন্য কার পার্কিং, খেলার মাঠ, রান্না ও স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা রয়েছে, তাই অনেকেই এখানে পিকনিক বা পরিবারের সঙ্গে দিন কাটাতে আসেন।
৪. পোড়াগাঁও ইকোপার্ক: পরিবেশবান্ধব সবুজের রাজ্য
নালিতাবাড়ীর পোড়াগাঁও এলাকায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই ইকোপার্কটি প্রকৃতি, বিনোদন এবং শিক্ষার এক অনন্য সমন্বয়। প্রায় ৬০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ উদ্যানজুড়ে রয়েছে ঔষধি ও বিরল প্রজাতির গাছের বনায়ন, দর্শন টাওয়ার, আধুনিক রেস্টহাউস, স্টার ব্রিজ এবং ছোট একটি চিড়িয়াখানা।
শিশুদের জন্য রয়েছে রাইড, প্যাডেল বোট, দেশি নৌকা ও ক্যান্টিন। দিনে মহুয়া রেস্ট হাউস ব্যবহার করা গেলেও রাত কাটাতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। শেরপুরের পর্যটন মানচিত্রে এটি এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোর একটি।
৫. সুতানাল দিঘি: ইতিহাস, লোককথা ও রহস্যে ঘেরা এক জলাধার
নালিতাবাড়ী উপজেলার শালমারা গ্রামে অবস্থিত প্রায় ২০ একর আয়তনের এই বিশাল দিঘিটি স্থানীয়ভাবে ‘সুতানাল দিঘি’ নামে পরিচিত। কেউ বলেন এটি ‘কমলা রানীর দিঘি’, কেউ আবার বলেন ‘রানী বিরহিনী’।
দিঘিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা লোককথা ও কিংবদন্তি। বছরের প্রায় প্রতিদিনই এখানে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা— কেউ ইতিহাস খুঁজতে, কেউ আবার শুধু শান্ত জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। বিকেলের সূর্য যখন দিঘির জলে প্রতিফলিত হয়, তখন দৃশ্যটা যেন এক টুকরো কবিতা।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি নালিতাবাড়ী বা শেরপুরগামী বাস পাওয়া যায় মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে। সকাল ৫টা ৫০ মিনিট থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাস ছাড়ে। ভাড়া ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে।
নালিতাবাড়ী পৌঁছে গড়কান্দা মোড় পর্যন্ত রিকশায় যেতে হবে (৩০–৪০ টাকা)। সেখান থেকে অটো বা সিএনজি রিজার্ভ করে (৫০০–৭০০ টাকা) ভ্রমণস্থানে যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে শেরপুরগামী বাসের ভাড়া প্রায় ৪০০–৬০০ টাকা। শেরপুর শহরের খোয়াড়পার স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি বা অটো নিয়ে সহজেই যাওয়া যায় বিভিন্ন স্পটে। চারআলী বাজার বা নাকুগাঁও থেকে অটোরিকশা রিজার্ভ করলে ভাড়া ২৫০–৪০০ টাকা, ভাগাভাগি ভাড়া ৫০–১২০ টাকার মধ্যে।
ইতিহাসের সাক্ষী শেরপুর: যত্নের অভাবে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
শেরপুরে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন, যেগুলোর কিছু এখন বিলুপ্তির পথে। বিশেষ করে পৌনে তিনআনি জমিদার পরিবারের ঐতিহ্যবাহী রংমহল একসময় ছিল শিল্পসৌন্দর্যে ভরপুর। আজ সেটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয় ইতিহাস ও স্থাপত্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।




