বিজ্ঞাপন স্থান

হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ: ইমানদারের নৈতিক চেতনা

মানুষকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন এক দায়িত্বশীল জাতি হিসেবে। এই পৃথিবীতে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, লেনদেন, আচরণ—সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি amanah বা আমানত, যা হক বা অধিকার হিসেবে বিবেচিত। একইভাবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেও রয়েছে নির্দিষ্ট কর্তব্য ও দায়িত্ব। সুতরাং, প্রতিটি মানুষের কর্তব্য হলো—স্রষ্টা ও সৃষ্টিজগৎ, উভয়ের হক যথাযথভাবে আদায় করা। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই মানুষ অন্য সব সৃষ্টির তুলনায় মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে।


এই দায়িত্বগুলো মূলত দুই ভাগে বিভক্ত: ১. হাক্কুল্লাহ — অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ২. হাক্কুল ইবাদ — মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও হক।

প্রত্যেক মানুষকেই জীবদ্দশায় এই দুটি হক যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করতে হবে, যাতে পরকালে প্রতিদান ও পুরস্কার লাভ করা যায়।

একটি সহিহ হাদিসে হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেছেন, একবার তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পেছনে একটি গাধার পিঠে আরোহী ছিলেন। রাসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "হে মুয়াজ! তুমি কি জানো, বান্দার ওপর আল্লাহর হক কী এবং আল্লাহর ওপর বান্দার হক কী?" তিনি বললেন, "আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।" তখন রাসুল (সা.) বললেন, “বান্দার ওপর আল্লাহর হক হলো, সে যেন কেবল আল্লাহরই ইবাদত করে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক না করে। আর আল্লাহর ওপর বান্দার হক হলো, যদি কেউ তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক না করে, তবে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন না।” (বুখারি: ২৮৫৬)

মানুষের প্রতি দায়িত্ব বা হাক্কুল ইবাদ অত্যন্ত বিস্তৃত একটি ক্ষেত্র। এতে শুধু ভালো ব্যবহার নয়, বরং অসহায়কে সাহায্য করা, গরিবকে খাদ্য ও বস্ত্র প্রদান করাও অন্তর্ভুক্ত। যেমন, এক হাদিসে হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে বস্ত্র দান করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ পোশাক পরাবেন” (তিরমিজি: ২৮৩৫)। আরও উল্লেখ রয়েছে—যদি কেউ ক্ষুধার্তকে আহার করায়, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন; আর তৃষ্ণার্তকে পানি পান করালে জান্নাতের শরবত পান করাবেন (আবু দাউদ: ১৭৫২)।

একইভাবে, বুখারি শরিফে উল্লেখ আছে—"তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থদের খোঁজখবর নাও, বস্ত্রহীনদের বস্ত্র দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও" (বুখারি: ২৪১৭)। নবীজি (সা.) বলেছেন, “তোমরা ভিক্ষুককে কিছু না কিছু দাও—even যদি তা একটি আগুনে পোড়া হাড়ও হয়” (মুসনাদে আহমাদ: ১৬৬৯৯)। তিনি আরও বলেন, “সে পূর্ণ মুমিন নয়, যে নিজে পরিপূর্ণ আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে” (বায়হাকি: ৩৩৮৯)।

মানবাধিকারের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, অন্য কারো হক নষ্ট করা মারাত্মক পরিণতির কারণ হতে পারে। রাসুল (সা.) বলেন, “যার ওপর তার ভাইয়ের হক রয়েছে—তা সম্মান হোক বা সম্পদের—সে যেন আজই তা পরিশোধ করে নেয় বা ক্ষমা চেয়ে নেয়। কারণ কিয়ামতের দিন কোনো সম্পদ দিয়ে তা শোধ করা যাবে না। তখন তার নেক আমল থেকে তা কেটে নেওয়া হবে, আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে, তবে হকদারের পাপ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে” (বুখারি)।

এই জন্যই, একজন মু’মিনের উচিত, দুনিয়াতে থাকা অবস্থায় মানুষের হক পরিশোধে সচেষ্ট থাকা এবং আল্লাহর হক পালনের মাধ্যমে নিজের পরকালকে সুন্দর করা। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে এ দুটি হকের যথাযথ আদায়কারী বানান—এই আমাদের প্রার্থনা।