কমলনগরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে প্রতারণার রমরমা ব্যবসা
লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলা দেশের ক্ষুদ্রতম উপজেলা হিসেবে পরিচিত। একদিকে মেঘনার ভাঙনে এ অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে; অন্যদিকে সহায়-সম্বল হারানো সাধারণ মানুষ আজ মানবেতর জীবনযাপন করছে। ঠিক এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, সহজ-সরল মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে।
ছোট্ট এই উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ১৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, যার মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনেই রয়েছে ৮টি। সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এসব প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে চিকিৎসা সেবার নামে কোটি টাকার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা পুরোপুরি অনুপস্থিত। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা প্রায় অদৃশ্যমান।
মানহীন সেবায় প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর জন্য প্রয়োজন হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন/আয়কর প্রত্যয়নপত্র, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও শ্রম অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, নারকোটিক পারমিট এবং যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা। পাশাপাশি প্রয়োজন প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট ও দু'জন দক্ষ টেকনিশিয়ান। কিন্তু কমলনগরের অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসবের কিছুই নেই।
শুধু মাত্র একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অদক্ষ লোক দিয়ে চলছে এক্স-রে, ইসিজি, রক্ত সংগ্রহসহ প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও সেরোলজির মতো জটিল কার্যক্রম। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ল্যাব পিয়ন, আয়া, বাবুর্চির মতো অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করানো হচ্ছে, যাদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ।
লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, উপজেলার করইতলা বাজার, ফজুমিয়ারহাট, করুনানগর বাজার ও হাজিরহাট বাজার এলাকায় গড়ে ওঠা ১৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে মাত্র দুটি সেন্টারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে। বাকি ১৭টি সেন্টারের কোনো অনুমোদন নেই বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সের ভিত্তিতে চলছে।
বিশেষ করে "নিউ মেঘনা" ও "বিসমিল্লাহ" ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোনো বৈধ অনুমোদনই নেই। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের নীরবতা এবং অবৈধ লেনদেনের কারণে দিন দিন এসব প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে।
সরকারি চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. সোহেল রানার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। তিনি সরকারি দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে ‘হাই কেয়ার’ নামে একটি মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসে নিয়মিত রোগী দেখছেন। এ নিয়ে সেবা প্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ বিষয়ে ডা. সোহেল রানা বলেন, “আমি হাই কেয়ারের মালিক নই। হাই কেয়ার কোনো অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে আপনারা লিখতে পারেন, এতে আমার কোনো সমস্যা নেই।”
কর্তৃপক্ষের অবস্থান
বিসমিল্লাহ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মোহাম্মদ আব্দুর রহমান দাবি করেছেন, তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সব নিয়ম মেনেই সেন্টার পরিচালনা করছেন।
অন্যদিকে, লক্ষ্মীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠান জানান, “কমলনগরের ১৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে মাত্র দুটি সেন্টার ছাড়পত্র পেয়েছে।”
শ্রম অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক প্রকৌশলী শরীফ আহাম্মেদ আজাদ বলেন, "শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা আমাদের দায়িত্ব। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলা হবে।"
কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. কাজী একরামুল হক বলেন, “রেজিস্ট্রেশন ও নবায়নবিহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে নির্দেশনা রয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আহাম্মদ কবীর জানান, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে এবং মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়।