দিনের আলো ফোটার আগেই, মক্কার অদূরে মিনার উপত্যকায় জড়ো হন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রায় ১৬ লাখ হজযাত্রী। তাঁরা মিনার তিনটি প্রতীকী কংক্রিট স্তম্ভে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করেন, যা হজের অন্যতম প্রতীকী ও তাৎপর্যপূর্ণ রীতি। ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, এই রীতি ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই স্মরণীয় ঘটনার প্রতীক—যেখানে তিনি আল্লাহর নির্দেশে তাঁর পুত্রকে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হলে, শয়তান তাঁকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিল। তখন ইব্রাহিম (আ.) শয়তানকে প্রত্যাখ্যান করে পাথর নিক্ষেপ করেন।
মিনার তাবু শহর থেকে হাজিরা ভোর হওয়ার আগেই রওনা হন। এ বছর আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত থাকায় এই রীতি পালনে সহজতা এসেছে। মিসরের ৩৪ বছর বয়সী ওয়ায়েল আহমেদ আবদেল কাদের বলেন, ‘মিনায় আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল সহজ-সরল। মাত্র পাঁচ মিনিটেই আমরা জামারাতে রীতি পালন শেষ করেছি।’ গিনির হাজী হাওয়াকিতা বলেন, ‘আমি যখন পাথর নিক্ষেপ করছিলাম, তখন এক ধরনের আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করেছি। আমি সত্যিই গর্বিত।’
এর আগের দিন হাজিরা আরাফাতের ময়দানে দিনভর প্রার্থনা ও কোরআন তেলাওয়াতে অংশ নেন। অনেকেই তীব্র রোদের মধ্যেও আরাফাতের ঐতিহাসিক ৭০ মিটার উঁচু পাহাড়ে আরোহণ করেন—যেখানে নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বিদায় হজের সময় শেষ খুতবা প্রদান করেন। যদিও সৌদি কর্তৃপক্ষ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঘরে থাকার নির্দেশনা জারি করায় দুপুর নাগাদ হাজীদের উপস্থিতি কিছুটা কমে আসে।
এই বছর হজের সময় তীব্র গরম উপেক্ষা করে ৫১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১২৫ ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় সৌদি সরকার নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়। বিশেষ করে অবৈধ হাজীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়, কারণ ২০২৪ সালে প্রায় ১,৩০১ হাজী মারা যান, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন অনুমতিপত্রবিহীন হাজী—যাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আশ্রয় বা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে সীমিত হজ ব্যবস্থাপনার পর এবারও আগের তুলনায় হজযাত্রীর সংখ্যা কম ছিল। গত বছর যেখানে ১৮ লাখের বেশি মুসলমান হজে অংশ নেন, এবার সংখ্যাটি কিছুটা কমেছে। হজের পারমিট কোটা অনুযায়ী দেশগুলোকে বরাদ্দ দেয়া হয় এবং সাধারণত লটারির মাধ্যমে তা বিতরণ করা হয়। তবে উচ্চ খরচের কারণে অনেকেই অনুমতি ছাড়াই হজ পালনের চেষ্টা করেন, যার ফলে গ্রেফতার ও বহিষ্কারের ঝুঁকি থাকে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে মিনায় পাথর নিক্ষেপ স্থানে ঘটে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, যেখানে পদদলিত হয়ে ২,৩০০ জনের বেশি হাজী প্রাণ হারান। এটি হজের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ট্র্যাজেডি হিসেবে বিবেচিত।
হজ ও উমরাহ থেকে প্রতি বছর সৌদি আরব বহু বিলিয়ন ডলার আয় করে। এই দুটি ধর্মীয় সফর দেশটির জন্য যেমন অর্থনৈতিক লাভজনক, তেমনি সৌদি বাদশাহর জন্য গৌরবের বিষয়, যিনি “মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদের রক্ষক” হিসেবে পরিচিত।
হজের সমাপ্তির সাথেই শুরু হয় ঈদুল আজহা, যা মুসলিম বিশ্বে ত্যাগ ও উৎসর্গের মহান শিক্ষা বহন করে। এ উপলক্ষে ছাগল, ভেড়া, গরু, উট প্রভৃতি পশু কোরবানি দেয়া হয় এবং এর গোশত দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়—যা ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে দৃঢ় করে।