ত্বক আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ । ত্বক আমাদের বিভিন্ন ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত ত্বক আমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে কিন্তু কখনো কখনো বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে ত্বক আমাদের যেমন সৌন্দর্যে হানি করে তেমনি ভাবে কিছু কিছু ত্বকের সংক্রমণ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
ত্বকের সংক্রমণ ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী, ছত্রাক বা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে এবং মাথার ত্বক সহ শরীরের যে কোন জায়গায় ঘটতে পারে।
এসব সংক্রামক রোগ অস্থায়ী কিংবা স্থায়ীভাবে হতে পারে। কিছু কিছু সংক্রমণ ব্যাথাহীন এবং কিছু কিছু সংক্রমণ বেদনাদায়ক হয়ে থাকে আবার কিছু কিছু সংক্রমণ জীবনের নাশের হুমকি হতে পারে। আজকের এই টপিক্সে আমরা ত্বকের বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে জানব এবং সেগুলো কিভাবে নিরাময় করা যায় সে ব্যাপারে জানব ।
ত্বক কি?
স্বাভাবিকভাবে ত্বক বলতে আমরা আমাদের বহিরাগতা আবরণ কে বুঝি অর্থাৎ প্রাণীদেহের সবচেয়ে বাহিরের যে প্রাকৃতিক আবরণ থাকে সেটাই হচ্ছে ত্বক। যেমন চামড়া, খোলক কেরফিজ, কিউটিকল,এগুলো ত্বকের আওতায় পড়ে।
অন্যভাবে বলতে গেলে প্রাণীদের আবৃতকরে রাখার নরম যে অঙ্গ সেটাই হচ্ছে ত্বক, যেটা প্রাণীদের বাহ্যিক প্রবাহের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে রক্ষা করে,পরিবেশের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। পাশাপাশি ত্বক ,রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে এবং শরীরের যেকোনো অতিরিক্ত পানি অপসারণে সহায়তা করে।
এছাড়াওআরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ত্বক , তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক, ইন্দ্রিয় ও ভিটামিন ডি উৎপাদক হিসেবে কাজ করে ।
চামড়া (Skin) ও ত্বক (Integument) এর মধ্যে পার্থক্য কী?
ত্বক বলতে প্রাণীদেহের দৃশ্যমান প্রাকৃতিক আবরণ কে বোঝায়, যেটাকে চামড়া খোলস বা বলা হয়।এক কথায় প্রাণীদেহের মাংসের উপরের দৃশ্যমান আবরণ। এই আবরণ মেরুদন্ডী - অমেরুদন্ডী উভয় প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়।
অন্যদিকে চামড়া (Skin) বলতে কেবলমাত্র মেরুদণ্ডীদের নরম বহিঃআবরণকে বোঝায়।
তবে সকল চামড়াই ত্বক কিন্তু সকল ত্বকই চামড়া নয়।
চর্মরোগ কি?
চর্মরোগ হল এক ধরনের ছত্রাক জনিত রোগ। আমাদের ত্বকে বিভিন্ন ছত্রাকের সংক্রমণের উপাদান থেকে ফোলাভাব, চুলকানি,জ্বালাপোড়া এবং লালচে দেখা দেখা যায় , যেটাকে আমরা চর্মরোগ হিসেবে মনে করি ।
মূলতকেরাটিন (Keratin) নামক এক ধরণের আমিষ আমাদের ত্বক, চুল এবং নখের গঠনে সহায়তা করে। ছত্রাক এই কেরাটিন ধ্বংস করে ফলে ত্বকে বিভিন্ন ছত্রাক দেখা যায়।এই ছত্রাকের ফলে আমাদের ত্বকের স্বাভাবিক আকারকেপ্রভাবিত করে। এসব ছত্রাকের সংক্রমণ গুলো প্রাথমিক অবস্থা চিকিৎসা করালে খুব সহজে দূর করা যায়।
চর্ম রোগের প্রধান কারণ কি?
ত্বকে যেকোনো ধরনের সংক্রমন মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, কি কি কারণ আমাদের ত্বকে সংক্রমন হয়ে থাকে চলুন জেনে নেই।
- ওষুধঃ অতিরিক্ত ওষুধের রিঅ্যাকশন আমাদের শরীরে অন্যান্য অর্গানের যেমন রিয়াক্ট করে তেমনিভাবে আমাদের চামড়াতে এর একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।যার ফলে আমাদের চামড়ায় বিভিন্ন সংক্রমণ দেখা দেয় আর সেখান থেকে চর্ম রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
- খাদ্যঃকিছু কিছু খাবার আছে যেগুলো খেলে চুলকানি বেড়ে যায় এবং শরীর ত্বকে জ্বালাপোড়া বেড়ে যায় যেমন বেগুন,আনারস কলা মাশরুম কোন কোন ক্ষেত্রে দুধ খাওয়ার ফলেও এলার্জি হওয়া সম্ভব থাকে।
- বয়সঃ চর্ম রোগের আরেকটি কারণ সবচেয়ে বেশি যে কারণটা সেটা হচ্ছে বয়স অধিক ,কারণ এসময় বয়স্ক ব্যক্তির চামড়া রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে
- গর্ভাবস্থাঃ গর্ভাবস্থায় নারীদের শরীরে হরমোনগত পরিবর্তন দেখা যায়। এ অবস্থায় কোন নারীর যদি চুলকানি কিংবা চর্মরোগ হয় তাহলে সেটা অনেকটা ভোগান্তির কারণ হতে পারে। যেমন একজিমা এ টপিক।
- ত্বকের ক্যান্সার।
- থাইরয়েড, লিভার অথবা কিডনির অসুখ।
- দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা।
- অপরিচ্ছন্ন ত্বকঃ চর্ম রোগের আরেকটি কারণ ধুলাবালি এবং নোংরা পরিবেশে জীবন যাপন করা।অপরিষ্কার জামা কাপড় পরিধান করা।
- জিনগত কারণঃ কোন কোন ক্ষেত্রে চর্মরোগ বংশগত কারণে হয়ে থাকে । এটি একটি বিশাল কারণও বটে ।জিনগত কারণে বংশের বা পরিবারের অন্য সদস্যের চর্মরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া।
- ত্বকে জ্বালা ধরে এমন রায়ায়নিক দ্রব্য।
- ডায়াবেটিসঃ ডায়াবেটিস রোগীদেরও চর্মরোগ হতে পারে ।
- ভাইরাস, ছত্রাক অথবা ব্যাকটিরিয়া।
ত্বকে কি কি ধরনের সংক্রমণ হতে পারে?
ত্বক আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ । বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে ত্বক আমাদের রক্ষা করে। যাইহোক কখনো কখনো আমাদের ত্বকে বিভিন্ন সংক্রমণ দেখা দেয়, এই সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে ,ব্যাকটেরিয়া ,পরজীবী, ছত্রাক ,ভাইরাস, ইত্যাদি । প্রাথমিক অবস্থায় এই সংক্রমণ গুলোর চিকিৎসা না করালে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
জেনে নেই আমাদের ত্বকে কি কি ধরনের সংক্রমণ হতে পারে-
সেলুলাইটিসঃ সেলুলাইটিস একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত ত্বকের সংক্রমণ যা বেশ সাধারণ কিন্তু খুবই গুরুতর।এই সংক্রমণের ফলে ত্বক লালচে হয়ে ফুলে যায়।এটি ত্বকের যে কোন জায়গায় হতে পারে তবে বেশিরভাগ পায়ে দেখা যায়। সেলুলাইটিস আক্রান্ত হলে, ত্বক লাল, ফুলে যায়। এসময় এটি স্পর্শ করলে ব্যথা অনুভূত হয়।
দাদঃ আমাদের ত্বকে আরেকটি পরিচিত সংক্রমণ হলো দাদ,দাদ একটি ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট ত্বকের সংক্রমণ । শরীরে কোন অংশে দাদ হলে চামড়া তখন চুলকায় এবং সেখানে লালচে বর্ণ হয়ে ফোসকা হয়।
ফলিকুলাইটিসঃ ফলিকুলাইটিস, তুলনামূলকভাবে ত্বকের অন্যান্য সংক্রমণ থেকে এটি সাধারণ সংক্রমণ । চুলের ফলিকলের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে হয়। এর ফলে আপনার ত্বকের লোমকূপের প্রদাহ হয়।তাই প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করালে অল্পতেই নিরাময় হয়। তবে মারাত্মক আকার ধারণ করলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
ব্রণঃ সাধারণত বয়সন্ধিকালে অথবা যাদের বয়স ১৮ থেকে ২০ বছর এ ধরনের ছেলে মেয়েদের এই রোগটি বেশি হয়ে থাকে।
ব্রণ থেকে মুক্তি পেতে তৈলাক্ত, ঝাল ও ভাজাপোড়া খাবারসহ চকলেট, আইসক্রিম ও অন্যান্য ফাস্টফুড খাওয়া কমাতে হবে৷
পাঁচড়াঃ সাধারণত শিশুদের এই রোগ হয়ে থাকে। যে সমস্ত শিশুরা অপরিষ্কার কাপড়-চোপড় পরিধান করে এবং নোংরা জায়গায় অবস্থান করে তাদের এই পাঁচড়া রোগহতে পারে। এ রোগ থেকে মুক্তি লাভের উপায় হলো, শিশুদের কে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা
একজিমাঃ একজিমা খুবই পরিচিত একটি চর্মরোগ। বেশিরভাগ লোককেই এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।এটি একটি এলার্জিজনিত রোগ। বিভিন্ন কারণে আমাদের শরীরে এই একজিমা হতে পারে ।ত্বকে কোন রাসায়নিক দ্রব্য লাগলে অথবা বাতাসের মাধ্যমে জীবাণু আমাদের শরীরে লাগলে অথবা এমন বিষাক্ত পোকামাকড় যেগুলো আক্রমণ করলে সেই ক্ষত থেকে একজিমা হওয়া সম্ভাবনা থাকে।
যেহেতু এটি ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ, সেহেতু এর জন্য দরকার অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ। একজিমা অনেক সময় নিরাময়যোগ্য রোগ নয়, একে শুধু নিয়ন্ত্রণ করা যায়।এজন্য ডাক্তারের পরামর্শে উপযুক্ত ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
কীভাবে ত্বকের সংক্রমণ প্রতিরোধ করবেন?
ত্বকে সংক্রমণ রোধের জন্য ,চিকিৎসার চেয়ে জরুরী হলো সচেতনতা. সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা এবং ত্বকের যেকোনো সংক্রমের ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং প্রাথমিক অবস্থায় এটাকে চিকিৎসার মাধ্যমে দূর করা ।
নিম্নে কয়েকটি ত্বক সংক্রমণ রোধের উপায় আলোচনা করা হলোঃ
- ত্বকে কোন ক্ষত থাকলে সেটাকে ঢেকে রাখা।
- সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। ভাল স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখুন।
- যদি আপনার শিশু বা একজন প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াপার ব্যবহার করে, সেটা যেন বারবার পরিষ্কার অথবা পরিবর্তন করা।
- ত্বকের সংক্রমণ আছে এমন ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকা।
- ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিস অন্য কাউকে ব্যবহার করতে না দেওয়া যেমনঃ তোয়ালে,গামছা, চিরুনি ইত্যাদি।
- আপনি যদি মনে করেন আপনার ত্বকে সংক্রমণ হয়েছে, বিশেষ করে আপনি যদি ডায়াবেটিক হয়ে থাকেন তাহলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।